ঢাকা , রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫ , ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কর কর্মকর্তা তানজিনা সাথী

তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়ে কোটিপতি

আপলোড সময় : ৩০-১১-২০২৪ ১২:০৪:৫৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ৩০-১১-২০২৪ ১২:০৪:৫৮ অপরাহ্ন
তথ্য গোপন করে চাকরি নিয়ে কোটিপতি
৩৬ বিসিএসের রাজস্ব কর্মকর্তা তানজিনা সাথী। এনআইডিতে তার স্থায়ী ঠিকানা বরিশালের বাকেরগঞ্জ। কিন্তু বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেওয়ার সময় তিনি স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন বরগুনা জেলায়। এটি স্পষ্টতই তথ্য গোপন করার শামিল, যা তার চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। শুধু তাই নয়, কর কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিপ্রাপ্তির তিন বছর পর তিনি তার মা-বাবার নামে টিন সনদ করিয়েছেন, যেখানে তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। অথচ তার মা গৃহিণী ও বৃদ্ধ বাবার দৃশ্যমান কোনো রোজগার নেই এবং এত এত অর্থকড়ির মালিক যারা (মা-বাবা), তিন বছর আগেও তারা করের তালিকাভুক্তই ছিলেন না। উপরন্তু, বিসিএস একই ব্যাচের (পুলিশ) আরেক কর্মকর্তার সঙ্গে তানজিনার ছিল খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তানজিনা এই মর্মে মামলা ঠুকে দিয়েছেন যে, তিনি সেই কর্মকর্তার কাছে তিন কোটি টাকারও বেশি পাওনা আছেন। এখানেই শেষ নয়। তানজিনা থাকেন মালিবাগে। তার অফিস টাঙ্গাইলে। বরাবরই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অফিস ফাঁকি দেওয়ার। দিনের পর দিন ভোগান্তির পর সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে তানজিনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফে। এ নোটিশের জবাবও তিনি যথাসময়ে দেননি। এমন পরিস্থিতিতেও তানজিনা সাথীকে সম্প্রতি বরং পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, তানজিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামানোর, যা নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে অনুসন্ধান পর্ব।

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মোসা. তানজিনা সাথীর বাবার নাম মো. মোশাররফ হোসেন মল্লিক, মাতা- মোসা. রানী বিলকিস। স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম- মধ্য নেয়ামতি, পোস্ট- নেয়ামতি, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। বাবা, মায়ের এনআইডিতেও একই ঠিকানা। তবে বাংলাদেশ কর্মকমিশন থেকে প্রকাশিত গেজেটে তার নামের পাশে নিজ জেলার ঘরে লেখা বরগুনা। এদিকে বিসিএসে যোগদানের আগে তিনি সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। সেখানেও স্থায়ী ঠিকানা লিখেছেন বরিশাল। ৩৮তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া তার ভাই মাহফুজুর রহমানের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বাকেরগঞ্জ দেখানো হয়েছে। আপন ভাইবোনের স্থায়ী ঠিকানায় ভিন্নতা বিস্ময়করই বটে!

এদিকে চাকরির আবেদনে তিনি নিজেকে সিঙ্গল দাবি করেছেন। অথচ বিসিএস পরীক্ষার আবেদন ফরম পূরণের আগে তিনি মো. শফিকুল ইসলাম নামের একজনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কাবিননামার তথ্য অনুসারে বিবাহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৩। মোহরানা দশ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষা-২০১৫ আবেদনের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল- মিথ্যা তথ্য প্রদান ও অসদুপায় অবলম্বনের শাস্তি : (১) কোনো প্রার্থী আবেদনপত্রে জ্ঞাতসারে কোনো ভুল বা মিথ্যা তথ্য প্রদান করলে বা প্রয়োজনীয় তথ্য গোপন করলে... তাকে উক্ত পরীক্ষাসহ কমিশন কর্তৃক অনুষ্ঠেয় পরবর্তী যে কোনো পরীক্ষার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে। (২) ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ফৌজদারি আইনে সোপর্দ করা যাবে এবং উক্ত প্রার্থীকে সার্ভিসে নিয়োগের পর এইরূপ কোনো তথ্য প্রকাশ ও তা প্রমাণিত হলে তাকে চাকরি হতে বরখাস্তকরণ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে আইনানুগ যে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

তথ্য গোপনের পাশাপাশি তানজিনার বিরুদ্ধে রয়েছে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগ। জানা গেছে, কর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের আগে তানজিনা ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকে চাকরি করেন। তার বেতন ছিল ২২-২৫ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বছরে তার বেতন দাঁড়ায় সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৭ বছরে কোনো টাকা খরচ না করলেও তার মোট আয় হয় ১৭ লাখ টাকা। তানজিনা সাথী তার আয়কর (২০২১-২২) ফাইলে স্থায়ী ঠিকানা লিখেছেন বরিশাল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তার নিট সম্পত্তি দেখিয়েছেন ২ কোটি ১৬ লাখ ১ হাজার ৫৯২ টাকা। এর মধ্যে তিনি শেয়ারবাজারে ৪৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। সঞ্চয়পত্র ৩৪ লাখ টাকার। এ ছাড়া ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার দেখিয়েছেন। এর আগের বছরের কর ফাইলে তিনি ২ কোটি ৫ লাখ টাকার সম্পদ দেখান। ২০১৮ সালে তিনি কর কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে প্রবেশকালে বিবরণীতে প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পদ দেখান। এ সম্পদ পৈতৃকভাবে প্রাপ্ত ধরা হলে, তানজিনার দুই ভাই ও তিন বোনও সমান সম্পত্তি পাওয়ার কথা। সেই হিসেবে তার বাবা-মায়ের অন্তত ১০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার কথা। অথচ তারা ট্যাক্স ফাইল ওপেন করেন মেয়ে তানজিনা কর অফিসে যোগদানের ৩ বছর পর। সে সময় দেখানো হয়, তার গৃহিণী মা ও বৃদ্ধ কর্মহীন বাবার মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকার সম্পদ। এত সম্পদের মালিক হয়েও তারা ২০২২ সালের আগে ট্যাক্স দেননি। আয়কর দপ্তরে তানজিনা চাকরি নেওয়ার তিন বছর পর (২০২১-২২) তার বাবা-মায়ের নামে ট্যাক্স ফাইল খোলা হয়। তারা বরিশালের বাসিন্দা হলেও ঢাকা কর অঞ্চল-৭-এর সার্কেল-১৫০ থেকে রানী বিলকিস (মা) নামের কর ফাইলে মোট ৩ কোটি ১১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৪ টাকা মূল্যের সম্পদ বিবরণী দেখানো হয়েছে। স্বর্ণের পরিমাণ দেখিয়েছেন ৩৮০ ভরি। এর মধ্য থেকে ৯৭ ভরি বিক্রি করেছেন, যার মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ লাখ ১২ হাজার ৩১ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি ভরি স্বর্ণের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৬০৮ টাকা, যা গত তিন বছরের বাজারমূল্য থেকে খুবই কম ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া রানী বিলকিস তার স্বামীর কাছ থেকে ৮৪ লাখ টাকা ঋণ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন কর বিবরণীতে। এর মধ্যে বিক্রির জন্য তানজিনার এক বন্ধুকে তিনি ১৫৩ ভরি স্বর্ণ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কর ফাইলে রানী বিলকিস তার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দেখিয়েছেন ঢাকার মালিবাগ। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী রানী বিলকিসের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা বরিশাল হলেও তানজিনা নিজ কর্মস্থল ঢাকায় মায়ের কর ফাইল খোলেন। একইভাবে তানজিনা তার কর্মস্থল থেকে বাবা মো. মোশাররফ হোসেন মল্লিকের নামেও একটি কর ফাইলও খুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, কর কর্মকর্তা তানজিনা তার অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বৈধ করার জন্যই নিজ কর্মস্থল থেকে বাবা-মায়ের নামে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেন।

তানজিনা সাথীর বর্তমান ঠিকানা, ফ্ল্যাট ৯সি, প্রমোট ব্লুবেল, ১৬১, ১৬১/১, ১৬৪, মালিবাগ, ঢাকা। তার মা রানী বিলকিসের আয়কর ফাইলেও স্থায়ী ঠিকানা মালিবাগ। সূত্রমতে, তানজিনার টাকায় উপরোল্লিখিত ঠিকানায় প্রায় ১৩শ বর্গফুটের এ ফ্লাট ক্রয় করা হয়েছে। সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, জনৈক দেলোয়ারের মাধ্যমে তানজিনা অবৈধভাবে অর্জিত টাকা বাবা-মায়ের নামে বৈধ করেন। তানজিনার টাকার উৎস নিয়ে ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে জানান, অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এর বাইরে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

জানা গেছে, ব্যাংকে চাকরি করার সময় তানজিনা প্রথম বিয়ে করেন। কর কর্মকর্তা হওয়ার পর তানজিনা আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। সেই ব্যক্তি ৩৬তম বিসিএসের পুলিশ কর্মকর্তা (এএসপি)। তাদের চার বছরের সম্পর্ক ছিল। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এর জেরে তানজিনা মামলা করেন ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সেই মামলার নথি ও পিবিআইয়ের তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, তাদের মধ্যে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্পর্ক ভেঙে গেলে সেই কর্মকর্তাকে ঘর সাজানো, আইফোন, জমি ক্রয়ের টাকা, নগদ অর্থ প্রদান বাবদ মোট ৩ কোটি ২৩ লাখ দিয়েছেন বলে দাবি করেন তানজিনা এবং তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। এ মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলায় পিবিআইয়ের কাছে তানজিনার পক্ষে সাক্ষ্য দেন ইসরাফিল হাসান। ইসরাফিলের সাক্ষ্য অনুযায়ী, এনএসআইয়ের এক ডেপুটি ডিরেক্টরকে তানজিনা ভাই হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার নাম সাইদুর রহমান লিটন। তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টি সাক্ষ্যতে উঠে এসেছে। জানা গেছে, সাইদুর রহমান লিটন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মাহবুবুর রহমানের ভাগ্নে। মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসপি) সাবেক সদস্য আনোয়ারা বেগম। ৩৬তম বিসিএসে তানজিনা সাথীর নিয়োগকালে সাইদুর রহমান লিটনের মামি আনোয়ারা বেগম পিএসসির সদস্য ছিলেন।

এদিকে তানিজনা সাথীর বর্তমান কর্মস্থল গাজীপুর কর অঞ্চল। এই কর অঞ্চলের আওতাধীন টাঙ্গাইল মধুপুর ২১ ও ঘাটাইল ২২ কর সার্কেলের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। টাঙ্গাইলে থাকাকালীন সময়ে তিনি ঠিকমতো অফিস করতেন না। এ নিয়ে সেবাগ্রহীতারা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এসব নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে টাঙ্গাইলের সেই কর কার্যালয় ভাংচুর করে, আগুন দেয়। অথচ এর পরও ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে তার উল্টো পদোন্নতি হয়েছে।

নিয়মিত অফিস না করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তানজিনা সাথীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও সময়মতো তিনি জবাব দেননি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে গেলে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার এক পদস্থ নারী কর্মকর্তা ও সাইদুর রহমান লিটনকে পরিবারের সদস্য দাবি করে প্রভাব খাটানোর অপচেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আনীত এসব অভিযোগের বিষয়ে কর কর্মকর্তা তানজিনা সাথীর বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় একাধিকবার। কিন্তু তিনি প্রথমে ফোন ধরেননি। এরপর তার কাছে পেশাগত পরিচয়সহ কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। হোয়াটসঅ্যাপেও একই রকম বার্তা পাঠানো হয়। এরপর একাধিকবার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ওপ্রান্ত থেকে কেটে দেওয়া হয়।

নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ