যোগদানের ছয় বছরে শাহিন আলম বনে যান শত কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ড্রাফটসম্যান শাহিন আলম শত কোটি টাকার মালিক
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
২৭-০৬-২০২৫ ০২:২৩:৫৯ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
২৭-০৬-২০২৫ ০২:২৩:৫৯ পূর্বাহ্ন
শাহিন আলম
বিশেষ প্রতিনিধি
শাহিন আলম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের শুভপুর ইউনিয়নের তেলিহাটি গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা জয়নাল আবেদীন ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। তিন ভাইয়ের মধ্যে শাহিন আলম মেজ। বাবার বাদাম বিক্রির টাকা দিয়ে টেনেটুনে চলতো তাদের সংসার। পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালে তিনি চাকরি পান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ড্রাফটম্যান পদে। আর এতেই ভাগ্য খুলে যায় তার। চাকরিতে যোগদানের ছয় বছরে শাহিন আলম বনে যান শত কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহিনের বাবা জয়নাল আবেদীনের কোনো সম্পত্তি ছিল না। স্থানীয় কাদৈর বাজারে বাদাম বিক্রি করতেন তিনি। তিন ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করতেন। ২০১৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের সুপারিশে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ড্রাফটম্যান পদে চাকরি পান শাহিন আলম। তার বড় ভাই রফিক ও ছোট ভাই সোহেল রানা সৌদি প্রবাসী ছিলেন।
শাহিন চাকরিতে প্রথম যোগদান করেন কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা জনস্বাস্থ্য দপ্তরে। এরপরই খুলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। রাতারাতি হয়ে যান বিপুল সম্পদের মালিক। বর্তমানে ঢাকা-কক্সবাজার রোডে চলাচল করে এমন একাধিক বিলাসবহুল স্লিপার কোচ রয়েছে তার। এছাড়া পণ্য পরিবহনের জন্য রয়েছে ১১টি ডাম্প ট্রাক, মাটি কাটার জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ১০টি স্কেভেটর। ঢাকা ও কুমিল্লায় ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও নামে-বেনামে তিনি গড়েছেন শত কোটি টাকার বেশি সম্পদ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবা জয়নাল আবেদীনের কোনো সম্পত্তি না থাকলেও চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে শাহিন আলম ৬ শতক জমি কেনেন। ওই জমিতে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করে গড়ে তোলেন একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। নানা অনিয়মের অভিযোগে তাকে ২০১৯ সালের মার্চে বরুড়া থেকে লাকসামে বদলি করা হয়। সেখানেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন শাহিন আলম।
তেলিহাটি গ্রামের অন্তত ৮ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান শাহিন আলম জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদানের পর যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। বদলাতে থাকে তাদের জীবন মান। রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। ড্রাফটম্যানের পদবি ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঠিকাদারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ঠিকাদারি ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করতে তার ছোট ভাই এবং এক নিকটাত্মীয়ের নামে দুইটি ঠিকাদারি লাইসেন্সও নেন। ওই লাইসেন্সগুলো দিয়ে তিনি কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি বাগিয়ে নেন। তার ঠিকাদারিসহ সকল অবৈধ সম্পদ দেখভালের জন্য ভাই মনির ও সোহেলকে প্রবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ঠিকাদারির সব কাজ শাহিন আলম নিজেই দেখাশোনা করেন।
লাকসাম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ৪ মার্চ তিনি লাকসামে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। এরপর সাবেক এলজিইডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের শ্যালক ও লাকসাম পৌরসভার সাবেক মেয়র মোহব্বত আলীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়মে। প্রবাস ফেরত ছোট ভাই সোহেল রানার নামে ‘রানা হাইটেক বিল্ডার্স’ নামে নেন একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স। এছাড়া এক নিকটাত্মীয়ের নামে শম্পা এন্টারপ্রাইজ নামক আরও একটি ঠিকাদারি লাইসেন্স তৈরি করেন। দুইটি লাইসেন্সে শাহিন আলম মন্ত্রীর শ্যালক মোহব্বতের সহযোগিতায় জনস্বাস্থ্যের কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেন। এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে অনেক।
৬ বছরে শত কোটি টাকার মালিক জনস্বাস্থ্যের ড্রাফটম্যান শাহিন
সূত্র আরও জানায়, শাহিন আলম এই কার্যালয় থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্পের ৩৩৫টি গভীর নলকূপ, একই অর্থ বছরের সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের ২০৮টি, অগ্রাধিকার মূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহ প্রকল্পের ২৫টি, গ্রাউন্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ১টি, আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন প্রকল্পের ২৯৮টি ও ২০২০-২১ অর্থ বছরের সমগ্র দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পের আরও ২০৮টি, ৭টি পাবলিক টয়লেট, আর্সেনিক ঝুঁকি নিরশন প্রকল্পের ২৫৭টি, পল্লি অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পের ২৫টি, ওয়াশ ব্লক নির্মাণের ৫টিসহ মোট এক হাজার ৩৬২টি গভীর নলকূপ স্থাপনে ভুয়া বিল ভাউচার করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থ বছরে সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহের ৩৮টি, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর নলকূপ বসানোর নামে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রকাশ্যে এলে শাহিন আলমকে ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর পঞ্চগড়ে বদলি করা হয়।
লাকসাম উপজেলা জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইফুল ইসলাম জানান, জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাফটম্যানের কাজ হচ্ছে নকশার কাজ সম্পাদন করা। এই পদটি ১০ম গ্রেডের। এ পদের কর্মকর্তারা উপজেলা পর্যায়ে এলে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করে থাকেন। ড্রাফটম্যান এবং সহকারী প্রকৌশলী একই গ্রেডের বেতন ও স্কেল একই পরিমাপের।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জনস্বাস্থ্য সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জানান, শাহিন আলম মূলত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন ড্রাফটম্যান। ২০২১ সালে চৌদ্দগ্রামে ১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার ১৯৭৫ মিটারের একটি ড্রেনের কাজ তৎকালীন রেলমন্ত্রী মজিবুল হকের প্রভাব খাটিয়ে তিনি বাগিয়ে নেন। পরে নিম্নমানের কাজ হওয়ায় আমরা একাধিকবার বাধা দিয়েছিলাম, এতে তিনি কোনো প্রকার কর্ণপাত করেননি। পরে কাজ শেষ না করেই সরকারি প্রভাব খাটিয়ে বিলের সিংহভাগ উত্তোলন করে চলে যান।
শাহিন আলমের যত সম্পদ
২০২০ সালের ১৮ মার্চ ১৯৭২নং দলিলে শুভপুরের তেলিহাটি মৌজায় ১০ শতক জমি কেনেন। যার বাজার মূল্য ৩০ লাখ টাকা। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট একই মৌজায় ১৫৫৮নং দলিলে ১০ শতক এবং ১৫৫৫নং দলিলে ১৬ শতক জমি ক্রয় করেন। যার মূল্য ৭৮ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট জেলার চান্দিনা উপজেলার থানগাঁও মৌজায় ৭৩৭৫নং দলিলে ৯.৩৪ শতক ভূমি ক্রয় করেন। যার বাজার মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। চান্দিনা উপজেলার বেলাশর মৌজায় ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট ৭৩৭৪ ও ৭৯৭৪নং দলিলে ২৫.১৪ তাংশ জমি ক্রয় করেন। যার বাজার মূল্য ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। স্থানীয় কাদৈর বাজারে আরও ৪০ শতক ভূমি ক্রয় করেন। যার বাজার মূল্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এছাড়াও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বাগিচা গাঁও এলাকায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের দুই হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ঢাকার খিলগাঁওয়ে কোটি টাকা মূল্যের আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এছাড়াও গ্রামের বাড়ি তেলিহাটিতে ৬ শতক জায়গা কিনে ২ কোটি টাকা ব্যয় করে নান্দনিক ডুপ্লেক্স তৈরি করেছেন তিনি।
শাহিন আলম ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ইফাদ মোটরস থেকে ৫টি বিলাসবহুল স্লিপার কোচ ক্রয় করেন। গাড়িগুলো বর্তমানে এশিয়ান ট্রান্সপোর্টের অধীনে ঢাকায় আরামবাগ থেকে কক্সবাজার রোডে যাতায়াত করে। প্রতিটি গাড়ির মূল্য দুই কোটি টাকারও বেশি। গাড়িগুলোর নাম্বার যথাক্রমে- ঢাকা মেট্টো-ব-১২-২৫৮৩
ঢাকার মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয় সূত্র মতে, গাড়িগুলো ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর রেজিস্ট্রেশন নম্বর পেয়ে সড়কে চলাচল শুরু করে।
৬ বছরে শত কোটি টাকার মালিক জনস্বাস্থ্যের ড্রাফটম্যান শাহিন
এছাড়াও পণ্য পরিবহনের জন্য ১১টি ডাম্পট্রাক রয়েছে, যার বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকা। ১৫ কোটি টাকার ১১টি স্কেভেটর (ভেকু) রয়েছে। ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের প্রিমিও গাড়িতে চলাফেরা করেন শাহিন আলম। এলাকায় চাউর হয়েছে দুবাইতেও রয়েছে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও নামে বেনামে রয়েছে বহু সম্পদ।
সম্পদ রক্ষায় শাহিন আলমের অভিনব কৌশল
নিজ অর্থায়নে ইফাদ মোটরস থেকে ক্রয় করে বিলাসবহুল ৩টি স্লিপার কোচ ঢাকা-কক্সবাজার রুটে চলচল করছে। তবে এসব গাড়ির কাগজপত্র তৈরি করেন প্রবাস ফেরত ছোট ভাই সোহেল রানার নামে। এখানেও অভিনব কৌশল গ্রহণ করেন। ছোট ভাই যেন এই সম্পদ আত্মসাৎ করতে না পারেন সেজন্য গোপনে নোটারি পাবলিক করে সম্পত্তিগুলো নিজ নামে লিখে নেন। একই কৌশল অবলম্বন করেন বড় ভাই মনির, রফিক, প্রথম স্ত্রী তাসলিমা ও দ্বিতীয় স্ত্রী ফারজানা মজুমদার লিমার নামে ক্রয় করা সম্পদ রক্ষায়।
২০২৪ সালের ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মিরহাজীরবাগের বাসিন্দা বাবুল মিয়া হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গত ১৮ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শাহিন আলমকে আসামি করা হয়। মামলা নং- ৪৫, তাং- ১৮/১১/২০২৪ইং
জনস্বাস্থ্যের ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল হক বলেন, শাহিন আলম ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বদলি হয়ে ফেনীতে ড্রাফটম্যান হিসাবে যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বিভাগীয় তদন্ত চলমান রয়েছে। তাছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে তার বেতনও বন্ধ রয়েছে। তিনি অফিসে আসেন খেয়াল খুশিমতো। নামে চাকরি করেন, মূলত তার পেশা ঠিকাদারি।
অভিযোগের বিষয়ে শাহিন আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকার মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে লেগেছে। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা। এক পর্যায়ে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : News Upload
কমেন্ট বক্স