পটুয়াখালী পওর সার্কেল এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর স্বেচ্ছাচারিতা ও ঘুষ দুর্নীতির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চলছে। বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য, দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জালিয়াত চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা কাউকে পরোয়া করছে না। ফলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম যথাসময়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, পটুয়াখালী পওর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান এবং দক্ষিণাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি গৃহীত বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩টি মাটির কাজের দরপত্রের মধ্যে ৫টি পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হলেও অবশিষ্ট ৭টি কাজের মধ্যে ৪টি কাজের কার্যাদেশ বা নোয়া প্রদান করা হয়েছে পটুয়াখালীর প্রতারক চক্রের জাল জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫টি লাইসেন্সের একটি মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এর অনুকূলে। পুনঃদরপত্র আহ্বান করা অবশিষ্ট ৫টি কাজের দরপত্র ১০ এপ্রিল গৃহীত হলেও দু’টি কাজের কার্যাদেশ মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এর অনুকূলে প্রদান করা হয়। মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ লাইসেন্সের নিয়ন্ত্রক আখতারুজ্জামান হিরু, এলাহি আলম ইভান এবং মিজানুর আলম ওরফে স্বপন মৃধার জাল জালিয়াতির অভিযোগে বরগুনা ও আমতলী আদালতে দু’টি মামলা চলমান রয়েছে। ৫টি লাইসেন্সের জাল জালিয়াতির ভুরি ভুরি প্রমাণ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, সিলেট ইত্যাদি পানি উন্নয়ন বোর্ড দপ্তরে পাওয়া গেছে। এছাড়া বরগুনা জজ কোর্টের বার কাউন্সিল হতে অলি আহমেদ নামের একজন ঠিকাদার এ সকল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই ৫টি লাইসেন্সের অনুকূলে কোন কাজ না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে সদ্য অবসরে যাওয়া পাউবো’র মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকার এবং বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবকে আইনগত নোটিশ পাঠিয়েছেন। এর বাইরে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাউবো মহাপরিচালক বরাবর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ সকল সার্টিফিকেটের জালিয়াতি নিরূপণ করে শাস্তি প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আইনগত নোটিশ এবং ঠিকাদারদের আবেদনসহ সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের নামে নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব কার্যাদেশ প্রদান করেন। এসব দরপত্রের দরপত্র মূল্যায়ন কিভাবে হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য সুদিপ্ত জানান, তিনি নদী তীর সংরক্ষণ কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের প্রাক্কলন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব স্যার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের ইজিপি আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পটুয়াখালীস্থ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মহোদয়ের টেবিলে বসে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান। তিনি আরও জানান, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেত্রে একইভাবে তাদের ইজিপি আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী পটুয়াখালীতে অবস্থান করে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আরেক সদস্য সাজু জানান, তিনি ছুটিতে থাকাবস্থায় তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বহি সদস্য ঝালকাঠির সহকারী প্রকৌশলীর পাসওয়ার্ডও রাকিব ব্যবহার করে পটুয়াখালী থেকে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন বলে তারা উভয়েই জানান।
এ বিষয়ে বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে কোন জাল জালিয়াতি পাওয়া যায়নি এবং মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের অন্যান্য দরপত্রে জাল সার্টিফিকেট থাকলেও বর্ণিত দরপত্রে কোন জাল সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি।’ কিন্তু কার মাধ্যমে কিভাবে তদন্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি এবং কোন তদন্ত প্রতিবেদন দেখাতে পারেননি প্রকৌশলী রাকিব। তিনি জানান, মেসার্স আল মামুনের প্রায় ৩শ’টি কাজ সমাপ্তির সার্টিফিকেট আছে; সে কারণে তিনি দরপত্র মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন বলে কাজ পেয়েছেন। আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এত অধিক সংখ্যক কাজ কোথায় কিভাবে সমাপ্ত করেছেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি সিলেট অঞ্চল থেকে প্রতিটি প্রায় ৫০ হাজার টাকা করে এক বছরে ১২০টি আরএফকিউ’র সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। সে কারণে তার সার্টিফিকেটের সংখ্যা বেড়েছে।
এক বছরে ১২০টি আরএফকিউ’র সার্টিফিকেট কিভাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে? এ বিষয়ে সিপিটিইউ হেল্প ডেস্কে টেলিফোন করে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, আরএফকিউ পদ্ধতি মানে Request for quotation পদ্ধতি বা কোটেশন প্রদানের অনুরোধ জ্ঞাপন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কোন দরপত্র আহ্বান করা হয় না এবং সাধারণত স্থানীয় কতিপয় ঠিকাদারকে কোটেশনের মাধ্যমে দর দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয় এবং সর্বনিম্ন রেস্পন্সিভ দরদাতার অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। তবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যেমন একটি দরপত্র পড়লেও চলে কিন্তু আরএফকিউ পদ্ধতিতে কমপক্ষে তিনটি রেস্পন্সিভ দরদাতা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে ১২০টি প্রায় ৫০ হাজার টাকার কাজের প্রতিটিতে সর্বনিম্ন রেস্পন্সিভ দরদাতা হওয়া বাস্তবে অসম্ভব। তাছাড়া ৬০ লক্ষ টাকার আরএফকিউ কাজকে ৫০ হাজার টাকার ১২০টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হলেও এখানে হয়ত সর্বোচ্চ ১০/১২ দফার কাজ থাকতে পারে। এ ধরনের বিভক্তি স্থানীয় ঠিকাদারকে আর্থিক যোগ্যতা কম থাকার কারণে সুবিধা দেয়ার জন্য করা যেতে পারে, তবে বিভক্তি করার ক্ষমতাবান ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধান বা হেড অব প্রকিউরিং এন্টিটি। সুতরাং সিলেট থেকে পটুয়াখালীর একজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১২০টি আরএফকিউ সার্টিফিকেট ইস্যু করায় অভিজ্ঞ মহলের মতে সেখানে জাল জালিয়াতি আছে অথবা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং, এ ধরনের সার্টিফিকেট দরপত্র মূল্যায়নের জন্য কখনও বিবেচনাযোগ্য বলে মনে হয় না।
এছাড়া আমিনুল ইসলাম নামের একজন ঠিকাদার জানান, মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজের মালিক আখতারুজ্জামান হিরু প্রতারক ঠিকাদারি চক্রের প্রধান খলনায়ক নুর ই এলাহি আলম ইভানের জাল জালিয়াতির দীক্ষাগুরু। তার লাইসেন্স মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ দ্বারা দাখিলকৃত বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দরপত্র যাচাই করলে শতভাগ অসংখ্য জাল সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। একই কাজের সার্টিফিকেট বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে একাধিকভাবে দাখিল করেছেন এমনও পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২ ফেব্রুয়ারি গৃহীত দরপত্রে যে ৪টি কাজ আল মামুন এন্টারপ্রাইজের অনুকুলে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে সেখানে জেভি পার্সেন্টেজ পরিবর্তন করে পটুয়াখালীর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামানের স্বাক্ষর জাল করে সংগ্রহ করা দু’টি জাল সার্টিফিকেট (দরপত্র আইডি- ২২১৭৭৯ এবং ২২২০৬২) রয়েছে। অথচ পিপিআর-২০০৮-এর ধারা ১২৭(৩) এবং ১২৭(৪) মোতাবেক এই ৫টি লাইসেন্স অন্তত ৩ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার কথা থাকলেও রহস্যজনকভাবে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীর এ সকল ঠিকাদার চক্র দীর্ঘদিন যাবত প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষর জাল করে শত শত জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে অবৈধভাবে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়ে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ উপার্জন করেছেন। বিষয়টি এতদিন দৃষ্টিগোচর থাকলেও গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আলোচনায় আসে এবং জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে তথ্য প্রমাণসহ একাধিক সংবাদ প্রচারিত হলে পটুয়াখালী এলজিইডিতে এ চক্রের আড়াই শতাধিক জাল সার্টিফিকেট ধরা পড়ায় এলজিইডি দপ্তরে তাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা যেমন- বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব, পটুয়াখালীর পওর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান এবং বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমান মিলে সদ্য অবসরে যাওয়া পাউবো’র মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এই প্রতারক ঠিকাদার চক্রকে আইনি সাজা থেকে রক্ষার্থে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতারক ঠিকাদার চক্র জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কাজ বাগিয়ে নিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন এবং এই অসাধু চক্র দরপত্রের দলিলাদি গোপনীয় এ ধরনের অজুহাত তুলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতারক চক্রকে আইনি সাজা হতে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত এবং সে মোতাবেক আইনগত নোটিশসহ রাষ্ট্রীয় বিধি বিধান এবং আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদেরকে রক্ষা করার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তারা। গত ১৩ মার্চ ও ১৬ মার্চ বরগুনার নদী তীর সংরক্ষণ কাজের দরপত্রে জালিয়াতি করা লাইসেন্সগুলোকে রেস্পন্সিভ দেখিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যদিও গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাদের জাল জালিয়াতি এবং প্রতারণার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তখনই তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা। কিন্তু অসাধু প্রকৌশলীগণ অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম (অবঃ) সরকারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির বাম্পার প্রস্তাব পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। কিন্তু মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন দিশেহারা।
প্রতারক ঠিকাদার চক্রের প্রধান খলনায়ক ইভান পদ্মা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখার ইজিপি আইডির পাসওয়ার্ড প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে ও অসংখ্য ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক দু’টির বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অনেকটা দায়সারাভাবে এড়িয়ে যান এবং জানান, পটুয়াখালীর জাল জালিয়াতি করা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এরপরেও মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের অনুকূলে বরগুনা থেকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এছাড়া সাবেক মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি গৃহীত বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩টি মাটির কাজের দরপত্রের মধ্যে ৫টি পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হলেও অবশিষ্ট ৭টি কাজের মধ্যে ৪টি কাজের কার্যাদেশ বা নোয়া প্রদান করা হয়েছে পটুয়াখালীর প্রতারক চক্রের জাল জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৫টি লাইসেন্সের একটি মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এর অনুকূলে। পুনঃদরপত্র আহ্বান করা অবশিষ্ট ৫টি কাজের দরপত্র ১০ এপ্রিল গৃহীত হলেও দু’টি কাজের কার্যাদেশ মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এর অনুকূলে প্রদান করা হয়। মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ লাইসেন্সের নিয়ন্ত্রক আখতারুজ্জামান হিরু, এলাহি আলম ইভান এবং মিজানুর আলম ওরফে স্বপন মৃধার জাল জালিয়াতির অভিযোগে বরগুনা ও আমতলী আদালতে দু’টি মামলা চলমান রয়েছে। ৫টি লাইসেন্সের জাল জালিয়াতির ভুরি ভুরি প্রমাণ খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, সিলেট ইত্যাদি পানি উন্নয়ন বোর্ড দপ্তরে পাওয়া গেছে। এছাড়া বরগুনা জজ কোর্টের বার কাউন্সিল হতে অলি আহমেদ নামের একজন ঠিকাদার এ সকল মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই ৫টি লাইসেন্সের অনুকূলে কোন কাজ না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে সদ্য অবসরে যাওয়া পাউবো’র মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকার এবং বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবকে আইনগত নোটিশ পাঠিয়েছেন। এর বাইরে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাউবো মহাপরিচালক বরাবর নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ সকল সার্টিফিকেটের জালিয়াতি নিরূপণ করে শাস্তি প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু আইনগত নোটিশ এবং ঠিকাদারদের আবেদনসহ সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের নামে নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব কার্যাদেশ প্রদান করেন। এসব দরপত্রের দরপত্র মূল্যায়ন কিভাবে হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির একজন সদস্য সুদিপ্ত জানান, তিনি নদী তীর সংরক্ষণ কাজের বিভিন্ন প্যাকেজের প্রাক্কলন প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব স্যার দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের ইজিপি আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে পটুয়াখালীস্থ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মহোদয়ের টেবিলে বসে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান। তিনি আরও জানান, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেত্রে একইভাবে তাদের ইজিপি আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী পটুয়াখালীতে অবস্থান করে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আরেক সদস্য সাজু জানান, তিনি ছুটিতে থাকাবস্থায় তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বহি সদস্য ঝালকাঠির সহকারী প্রকৌশলীর পাসওয়ার্ডও রাকিব ব্যবহার করে পটুয়াখালী থেকে দরপত্র মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছেন বলে তারা উভয়েই জানান।
এ বিষয়ে বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজের দরপত্রে কোন জাল জালিয়াতি পাওয়া যায়নি এবং মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের অন্যান্য দরপত্রে জাল সার্টিফিকেট থাকলেও বর্ণিত দরপত্রে কোন জাল সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি।’ কিন্তু কার মাধ্যমে কিভাবে তদন্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি এবং কোন তদন্ত প্রতিবেদন দেখাতে পারেননি প্রকৌশলী রাকিব। তিনি জানান, মেসার্স আল মামুনের প্রায় ৩শ’টি কাজ সমাপ্তির সার্টিফিকেট আছে; সে কারণে তিনি দরপত্র মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন বলে কাজ পেয়েছেন। আল মামুন এন্টারপ্রাইজ এত অধিক সংখ্যক কাজ কোথায় কিভাবে সমাপ্ত করেছেন? জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি সিলেট অঞ্চল থেকে প্রতিটি প্রায় ৫০ হাজার টাকা করে এক বছরে ১২০টি আরএফকিউ’র সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। সে কারণে তার সার্টিফিকেটের সংখ্যা বেড়েছে।
এক বছরে ১২০টি আরএফকিউ’র সার্টিফিকেট কিভাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে? এ বিষয়ে সিপিটিইউ হেল্প ডেস্কে টেলিফোন করে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, আরএফকিউ পদ্ধতি মানে Request for quotation পদ্ধতি বা কোটেশন প্রদানের অনুরোধ জ্ঞাপন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে কোন দরপত্র আহ্বান করা হয় না এবং সাধারণত স্থানীয় কতিপয় ঠিকাদারকে কোটেশনের মাধ্যমে দর দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয় এবং সর্বনিম্ন রেস্পন্সিভ দরদাতার অনুকূলে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। তবে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যেমন একটি দরপত্র পড়লেও চলে কিন্তু আরএফকিউ পদ্ধতিতে কমপক্ষে তিনটি রেস্পন্সিভ দরদাতা থাকতে হয়। এক্ষেত্রে ১২০টি প্রায় ৫০ হাজার টাকার কাজের প্রতিটিতে সর্বনিম্ন রেস্পন্সিভ দরদাতা হওয়া বাস্তবে অসম্ভব। তাছাড়া ৬০ লক্ষ টাকার আরএফকিউ কাজকে ৫০ হাজার টাকার ১২০টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হলেও এখানে হয়ত সর্বোচ্চ ১০/১২ দফার কাজ থাকতে পারে। এ ধরনের বিভক্তি স্থানীয় ঠিকাদারকে আর্থিক যোগ্যতা কম থাকার কারণে সুবিধা দেয়ার জন্য করা যেতে পারে, তবে বিভক্তি করার ক্ষমতাবান ক্রয়কারী কার্যালয় প্রধান বা হেড অব প্রকিউরিং এন্টিটি। সুতরাং সিলেট থেকে পটুয়াখালীর একজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১২০টি আরএফকিউ সার্টিফিকেট ইস্যু করায় অভিজ্ঞ মহলের মতে সেখানে জাল জালিয়াতি আছে অথবা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং, এ ধরনের সার্টিফিকেট দরপত্র মূল্যায়নের জন্য কখনও বিবেচনাযোগ্য বলে মনে হয় না।
এছাড়া আমিনুল ইসলাম নামের একজন ঠিকাদার জানান, মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজের মালিক আখতারুজ্জামান হিরু প্রতারক ঠিকাদারি চক্রের প্রধান খলনায়ক নুর ই এলাহি আলম ইভানের জাল জালিয়াতির দীক্ষাগুরু। তার লাইসেন্স মেসার্স আল মামুন এন্টারপ্রাইজ দ্বারা দাখিলকৃত বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দরপত্র যাচাই করলে শতভাগ অসংখ্য জাল সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। একই কাজের সার্টিফিকেট বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে একাধিকভাবে দাখিল করেছেন এমনও পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২২ ফেব্রুয়ারি গৃহীত দরপত্রে যে ৪টি কাজ আল মামুন এন্টারপ্রাইজের অনুকুলে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে সেখানে জেভি পার্সেন্টেজ পরিবর্তন করে পটুয়াখালীর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামানের স্বাক্ষর জাল করে সংগ্রহ করা দু’টি জাল সার্টিফিকেট (দরপত্র আইডি- ২২১৭৭৯ এবং ২২২০৬২) রয়েছে। অথচ পিপিআর-২০০৮-এর ধারা ১২৭(৩) এবং ১২৭(৪) মোতাবেক এই ৫টি লাইসেন্স অন্তত ৩ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার কথা থাকলেও রহস্যজনকভাবে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তাদেরকে কার্যাদেশ দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, পটুয়াখালীর এ সকল ঠিকাদার চক্র দীর্ঘদিন যাবত প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষর জাল করে শত শত জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে অবৈধভাবে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়ে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ উপার্জন করেছেন। বিষয়টি এতদিন দৃষ্টিগোচর থাকলেও গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে আলোচনায় আসে এবং জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে তথ্য প্রমাণসহ একাধিক সংবাদ প্রচারিত হলে পটুয়াখালী এলজিইডিতে এ চক্রের আড়াই শতাধিক জাল সার্টিফিকেট ধরা পড়ায় এলজিইডি দপ্তরে তাদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা যেমন- বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব, পটুয়াখালীর পওর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান এবং বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমান মিলে সদ্য অবসরে যাওয়া পাউবো’র মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এই প্রতারক ঠিকাদার চক্রকে আইনি সাজা থেকে রক্ষার্থে একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতারক ঠিকাদার চক্র জাল জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করে কাজ বাগিয়ে নিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন এবং এই অসাধু চক্র দরপত্রের দলিলাদি গোপনীয় এ ধরনের অজুহাত তুলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রতারক চক্রকে আইনি সাজা হতে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত এবং সে মোতাবেক আইনগত নোটিশসহ রাষ্ট্রীয় বিধি বিধান এবং আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদেরকে রক্ষা করার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তারা। গত ১৩ মার্চ ও ১৬ মার্চ বরগুনার নদী তীর সংরক্ষণ কাজের দরপত্রে জালিয়াতি করা লাইসেন্সগুলোকে রেস্পন্সিভ দেখিয়ে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। যদিও গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাদের জাল জালিয়াতি এবং প্রতারণার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তখনই তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা। কিন্তু অসাধু প্রকৌশলীগণ অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের পাশাপাশি মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম (অবঃ) সরকারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির বাম্পার প্রস্তাব পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। কিন্তু মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ হয়ে যাওয়ায় তারা এখন দিশেহারা।
প্রতারক ঠিকাদার চক্রের প্রধান খলনায়ক ইভান পদ্মা এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পটুয়াখালী শাখার ইজিপি আইডির পাসওয়ার্ড প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করে ও অসংখ্য ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি ইস্যু করে ব্যাংক দু’টির বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মজিবুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি অনেকটা দায়সারাভাবে এড়িয়ে যান এবং জানান, পটুয়াখালীর জাল জালিয়াতি করা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এরপরেও মেসার্স রিয়াজ উদ্দিন আহমেদের অনুকূলে বরগুনা থেকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। এছাড়া সাবেক মহাপরিচালক নুরুল ইসলাম সরকারকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।