
বিশেষ প্রতিনিধি
চট্টগ্রামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে টিকিট কালোবাজারি ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত দুর্নীতির চক্র। অভিযোগ রয়েছে, এই চক্রের সঙ্গে রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), রেলওয়ে গভর্নমেন্ট পুলিশ (জিআরপি), বুকিং সহকারী, টিটিই, এটেনডেন্ট ও গাইডদের মধ্য থেকে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি জড়িত। চক্রটি মূলত রেলের টিকিটগুলো সাধারণ যাত্রীদের নাগালের বাইরে রেখে তা বাড়তি দামে বিক্রি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি অভিযানে কালোবাজারির অভিযোগের প্রমাণ মেলায় দুই আরএনবি সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এই দুই সদস্যের বাইরেও আরএনবির আরও কিছু সদস্য এই কালোবাজারি চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। এমনকি এর আগেও দুর্নীতির অভিযোগে ট্রেনে আরএনবির এস্কর্ট ডিউটিও বাতিল করা হয়।
ছুটির দিনে চক্রের দাপট বেড়ে যায় ,বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটি ও ঈদের সময় যাত্রীদের বাড়তি ভিড় লক্ষ্য করে চক্রটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময় টিকিটপ্রত্যাশী সাধারণ যাত্রীদের টার্গেট করে আরএনবি সদস্যরা ‘ইশারায়’ ডেকে এনে অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি করেন। এই প্রক্রিয়ায় রেলের নির্ধারিত নিয়মকানুন উপেক্ষা করে চক্রের হাতে চলে যায় বিশাল পরিমাণ টিকিট, যা চাহিদার বিপরীতে মূল্যের অনেক বেশি দামে বিক্রি হয়।
টিকিট ছাড়াই যাত্রী পরিবহন, টাকা নিজের পকেটে
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে কর্তব্যরত কিছু অসাধু আরএনবি সদস্য, বুকিং সহকারী, টিটিই, এটেনডেন্ট ও গাইড ডিউটির সুবিধা নিয়ে নিয়মিতভাবে টিকিট ছাড়াই যাত্রী পরিবহন করেন। পরে সেই টিকিটের দাম নিজের পকেটে রাখেন তারা। শুধু তাই নয়, কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের লোক দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করে কালোবাজারে বিক্রিও করা হয়।
গত ২৮ মে এই চক্রকে ধরতে ছদ্মবেশে অভিযান চালায় দুদক। অভিযানে আরএনবি সদস্যদের কাছ থেকে সরাসরি টিকিট কিনে কালোবাজারির প্রমাণ পান কর্মকর্তারা। সিপাহি আরিফুর রহমান ও রাকিবুল ইসলামকে হাতেনাতে আটক করে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
১৮ জনের সংঘবদ্ধ চক্র
বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রেলওয়ের এই টিকিট কালোবাজারিতে আরএনবির ১৪ জন সদস্য সরাসরি জড়িত। তারা হলেন—সিপাহি আরিফুর রহমান, আলমগীর হোসেন, ওয়াহিদ উল্লাহ, জাহিদ চৌধুরী, অজয় দাশ, মো. রফিক, রেজাউল করিম, মো. আমিরুজ্জামান, মো. আবদুর রহিম (সিজিএমওয়াই মার্শালিং ইয়ার্ড), মো. মামুন, হাবিলদার আল-আমীন, মামুন মিয়া, সালাউদ্দিন, বুকিং সহকারী এনায়েত হোসেন, বুকিং সহকারী মাহমুদুল হাসান,হাবিলদার পংকজ রায়, সিপাহী সুজন দত্ত বহিরাগতদের মধ্যে জড়িত রয়েছেন মজনু আলম। আনসার বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও কালোবাজারির অভিযোগ আছে—বিশেষ করে ‘স্বপন’ নামে একজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। রেল পুলিশের কনস্টেবল কালাম ও বিল্লাল নামের দুজন সদস্যকেও এই চক্রে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘স্টেশনজুড়ে দুর্নীতির দাপট’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আরএনবি সদস্য জানান, চট্টগ্রাম স্টেশন এলাকায় এই কালোবাজারিতে নির্দিষ্ট একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। এতে বাহিনীর সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তারা।
অভিযুক্তদের প্রতিক্রিয়া যোগাযোগ করা হলে সিপাহি আলমগীর, আমিরুজ্জামান ও আবদুর রহিম অভিযোগ অস্বীকার করেন। হাবিলদার আল-আমিন ফোন রিসিভ করার পর প্রতিবেদকের পরিচয় জানার সঙ্গে সঙ্গে ‘রং নম্বর’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পংকজ রায় ও সুজন দত্তকে বার বার ফোন করেও পাওয়া যায়নি, মোবাইলে বার্তা পাঠালেও কোন জবাব দেওয়া হয়নি।অন্যদিকে বাকি অভিযুক্তদের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
রেল পুলিশের কনস্টেবল কালামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনিও অভিযোগ অস্বীকার করেন। অপর অভিযুক্ত বিল্লাল কোনো কল রিসিভ করেননি।
প্রশাসনের অবস্থান
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরএনবি পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলাম বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারির সময় দুদকের হাতে ধরা পড়া আরএনবি সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া আমরা এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’