জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল ১১ কোটি টাকার কাজে অনিয়ম

পুরো মাল সরবরাহ না করেই বিলের টোকেন নিয়েছেন ঠিকাদার

আপলোড সময় : ৩০-০৬-২০২৫ ০১:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ৩০-০৬-২০২৫ ০১:০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন


জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে (নিরেটার) যেন এক পুরনো চুরির মতো ঘটনা ঘটেছে। মালামাল পরিবহনের পর না দিয়েই কোটি কোটি টাকার প্রতিস্থাপন দেখানোর অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি-চাচাই শুরু করেছে। এলজি অফিসে বিল জমা দিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও অসঙ্গতি। তারপ্রবাহে কাজ শেষ না হওয়ার আগেই বিলের টোকেন নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। একজন পরিচালক বলছেন, নিয়ম মেনেই বিল দেয়া হয়েছে।

সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩টি প্রতিষ্ঠান জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে ১১ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ পেয়েছে। তবে সরঞ্জাম পরিবহনের সরবরাহ না দিয়েই রয়েছে বিলের টোকেন নিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। যে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়েছে সেগুলো হচ্ছে- জোয়াহার ইন্টারন্যাশনাল, ওভারসিজ ইন্টারন্যাশনাল, মিজান ট্রেডিং। এই কোম্পানির মালিক সাবেক এমপি ছেলুন জোয়াহারের ব্যবসায়িক সহযোগী হাসান। আওয়ামী লীগে আনালেও কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়েছে এই হাসান।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এখানে সিটস্ক্যানের মধ্যে তিনটি সিটি স্ক্যানারের প্রতিটিই দীর্ঘদিন ধরে বিকল রয়েছে। অথচ কেবল তিনটি মেশিনের ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। প্রতিটি মেশিন প্রতিস্থাপন করার কথা বলে, সেই অর্থে প্রতিস্থাপনের কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত কোনো চুক্তিপত্র বা কার্যাদেশ পর্যন্ত নেই। শোভাবর্ধন কাজ করেও লক্ষ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছে। ইতালির তৈরি একটি অটোক্লেভ মেশিন, যার মেরামতের খরচ এক কোটি টাকা, সেটি নষ্ট পড়ে আছে দীর্ঘদিন। মেশিনটি চালু না করেই মেরামতের বিল করা হয়েছে।

হাসপাতাল থেকে কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, "তালিকায় উল্লেখ যে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দেখানো হয়েছে তার অনেকগুলোই নেই। হাসপাতালের বহু সরঞ্জামাদি লকারে তালা লাগানো অবস্থায় রাখা হয়েছে যাতে অনুসন্ধানকারীরা ভেতরে ঢুকে সবকিছু দেখতে না পারেন।" এমনকি এক এক্সরে মেশিন, যা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, সেটিরও প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয়েছে।

চিকিৎসা সরঞ্জামের তালিকায় রয়েছে – ডিজিটাল এক্সরে মেশিন ২টি, পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ২টি, অ্যানাস্থেসিয়া মেশিন ৬টি, ভেন্টিলেটর ২৪টি, ইনফিউশন পাম্প ২৪টি, সিরিঞ্জ পাম্প ৩০টি, অ্যাম্বু ব্যাগ ৬০টি, প্যাশেন্ট মনিটর ৪০টি, ইসিজি মেশিন ৪টি, সাকশন মেশিন ১২টি, নেবুলাইজার ২০টি, অক্সিজেন সিলিন্ডার ৫০টি, অক্সিজেন মাস্ক ৮০টি, বিছানা ৫০টি, সেলাইন স্ট্যান্ড ৫০টি, হুইল চেয়ার ৫টি, স্ট্রেচার ৫টি, স্লিপিং বেড ৫০টি, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই ইউনিট ১৪টি এবং ল্যাবের বিভিন্ন সরঞ্জাম।

তালিকার পিপি অংশে আছে গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার, অ্যাপ্রোন, ক্যাপ, পিপিই, গগলস, ফেসশিল্ডসহ নানা সামগ্রী। এগুলোর প্রায় সবই বিল করা হয়েছে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি দামে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি গ্লাভস পিপির ইউনিট রেট ধরা হয়েছে ৪ টাকা ৫০ পয়সা, বাজারে এক জোড়া গ্লাভসের দাম ৩ টাকা; প্রতিটি মাস্কের দাম ৮ টাকা ৫০ পয়সা, বাজারে ৩ টাকা; অ্যাপ্রোন ৪০ টাকা পিস, বাজারে ২০ টাকা; গগলস ৭০ টাকা পিস, বাজারে ৪০ টাকা; ফেসশিল্ড ১২০ টাকা পিস, বাজারে ৬০ টাকা; ক্যাপ ১২ টাকা পিস, বাজারে ৬ টাকা; স্যানিটাইজার (২০০ এমএল) ১৫০ টাকা পিস, বাজারে ৮০ টাকা; থার্মোমিটার ৪২০ টাকা পিস, বাজারে ২০০ টাকা; অক্সিমিটার ১৮০০ টাকা, বাজারে ৮০০ টাকা।

ক্লাস ওয়ান পিপি হিসেবে যেগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একেকটির মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ হাজার টাকা। এসব পিপির গুণগত মান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এসব পিপি সাধারণ মানের, যা বাজারে সহজে পাওয়া যায়। সেগুলো ২ থেকে ৩ হাজার টাকার বেশি নয়। অথচ একই পিপির মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ হাজার টাকা, ৯ হাজার টাকা, সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা। হিসেব ফাঁপা।

স্যানিটাইজার রোল ৬ ইঞ্চি একটি আইটেমের, যার ভর্তা ৯ হাজার পিস ছিল, যা এক পিপি হাসপাতালটোকেই বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন সিনিয়র টেকনিশিয়ান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ১১ কোটি টাকার মধ্যে বেশিরভাগই পিপির মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটি টাকার, কোনো গুণগত ব্যবহারও ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক। তারা বলেন, প্রতিটি হাসপাতালেই ইনডেন্ট করা হয়, হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী সরঞ্জাম কেনা হয়। কিন্তু এখানে কোনো ইনডেন্ট ছাড়াই পিপির একটি নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে কেবল বিল তৈরি করা হয়েছে। কাগজে-কলমে সরঞ্জাম ঢুকেছে, কিন্তু কোনো ব্যবহার ছাড়াই সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।

হাসপাতালের একজন এমএস কম রয়েছেন। তবে গুণগতমান বিহীন এসব পিপি ঢুকেছে কিভাবে – জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা বলেন, "কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠানো হয়েছে।" কীভাবে পাঠানো হয়েছে বা কেন পাঠানো হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি। এই কর্মকর্তা বলেন, "উর্ধ্বতনদের নির্দেশে অনেক কিছু হয়। আমরা শুধু রিসিভ করি।"

এদিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে জানা গেছে, চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার পদে থাকা একজন কর্মকর্তার নির্দেশে পুরো টেন্ডার-বাহিত কাজটি সম্পন্ন হয়। এসব তথ্য পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট দেশ হিসাবরক্ষকের কাছ থেকে, তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হিসাবরক্ষক হিসেবে ফান্ড লোকেশনসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখেন। ৮-১০ বছরের লোকেশন নিশ্চিত দিয়ে থাকেন হাসপাতালের জন্য। আমাদের হাসপাতালের হিসাব চেক করতে চাওয়া হচ্ছে বলে তিনি একাধিক বিষয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানান।

হাসপাতালের একাধিক রুম সরেজমিন গেলে সেখানেই দেখা যায় সিলগালা তালা লাগানো হয়েছে। অনেকগুলো রুমে কাগজ-পত্র, ফাইল, ওষুধের বোতল ও পুরনো টুল পড়ে থাকতে দেখা যায়। তেমন কোনো জানালাও নেই যেখান দিয়ে ভালো করে দেখা যায়।

এ বিষয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের পুনর্গঠন প্রতিষ্ঠাতার (নির্বাহী) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, "আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চাইছি। যারা দায়ী, যারা অডিট রিপোর্ট করেছে তাদের ধরে তদন্তের আওতায় আনা হোক। আমি হাসপাতালে ছিলাম না, বাইরে ছিলাম। জানি না, এখানে কী হয়েছে। যারা পিপি রিসিভ করেছেন, যারা অডিট রিপোর্ট করেছে, তারা বলবে। আমাদের হাসপাতালের চিকিৎসা অনেক ভালো। এখানে আসেন অনেক রোগী।" তবে তার কোনো অনিয়ম নেই বলে দাবি করেন তিনি।

১১ কোটি টাকার মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছেন চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার। তিনি গত দুই মাস ধরে কর্মস্থলে আসছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ নিরীক্ষা ইউনিটের একজন পরিচালক বলেন, "আমরা তদন্ত করছি, অডিটের কাজ করছি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"

চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্ত আইডিএইচকে দেখাতে চেয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরিচালক ডাক্তারের পক্ষ থেকে রাসূল জামান জানান, এখনই কিছু বলা যাবে না।

সম্পাদকীয় :

উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য : ডাঃ মোঃ হাফিজুর রহমান
সম্পাদক : তোফাজল আহমেদ ফারুকী
ব্যাবস্থাপনা সম্পাধক : আব্দুল্লাহ রানা সোহেল
প্রকাশক : মোঃ সোহেল রানা
বার্তা সম্পাদক : মোঃ আব্দুল কাদের জিলানী
প্রধান প্রতিবেদক : হাসিবুর রহমান হাসিব 

যোগাযোগের ঠিকানা :

লাবিনা এপার্টমেন্টে # বাড়ি এ-৩, রোড # ০৮, সেক্টর #০৩,উত্তরা
উত্তরা মডেল টাউন -ঢাকা -১২৩০, বাংলাদেশ

মোবাইল :  ০১৭১৭-৬৭৬৬৬৪

ই-মেইল :  dailyvoicenews247@gmail.com